দিল্লি ভ্রমনের গল্প ৩

লিয়াকত হোসেন খোকনের দিল্লি ভ্রমণের গল্প

সম্রাট শাহজাহানের রাজধানী ছিল দিল্লি এজন্যই বারবার ওখানে গিয়ে ঘুরে দেখার ইচ্ছে-স্বপ্ন কি আর পূরণ হয়! যেন দেখে দেখে আঁখি না ফেরে। হুমায়ুন, জাহানারা, মির্জা গালিব, দারা, সুজা, নিজামউদ্দিন আউলিয়া, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধীর কথা স্মরণ করে এই তো কিছুদিন আগে দিল্লির পথে পা বাড়ালাম। ঢাকা হয়ে সড়কপথে এলাম কলকাতায়। সঙ্গে ছিল বড় ছেলে অলি শাহরিয়ার হাসান এবং ভাইয়ের ছেলে শাকিল হাসান রানা। কলকাতায় রাত ৮টায় পৌঁছে রাতযাপন করে পরদিন বেলা ১১টায় এলাম ফেয়ারলি প্লেসে। ওখান থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকিট নিলাম। দুদিন পর বিকাল ৪টায় ট্রেন ছাড়ার সময়। প্রতীক্ষার পর ট্রেন ছাড়ার দিন এলো। বেলা ২টায় ট্যাক্সি ভাড়া করে তিনজন এলাম হাওড়া রেলস্টেশনে। ট্রেন ছাড়ল বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে। আমাদের পাশের সিটে ছিলেন একজন অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক। অপর পাশে ভুটানি এক ভদ্রমহিলা। উভয়ে বেশ মনখোলা, বেশ আলাপি। একের পর এক জিজ্ঞাসা তাদের। ইংরেজিতে উত্তর দিচ্ছে আমার ছেলে। দেখলাম, সবে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বেশ ভালোই ইংরেজি বলছে। একটু পর ওয়েটার খাওয়ার ম্যানু নিয়ে এলো। বললাম, নন ভেজিটেরিয়ান। ইতিমধ্যে চা-বিস্কুট এলো। রাত ৮টা বাজতেই এলো খাবার। এর পরে যে যার সিটে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকাল হতেই অপেক্ষা, কখন দিল্লি পৌঁছব। ইতিমধ্যে কানপুর ছেড়ে ট্রেন চলছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রেন বলে গ্লাসের ওপর দিয়ে বাইরের দৃশ্য চোখে পড়ছে। স্পষ্ট না হলেও কিন্তু অস্পষ্ট নয়। একসময় দেখি পথের বাঁকে ময়ূরের দল। তখন ভাবলাম, বাহ্ এরা তো বেশ নিরাপদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাখির প্রতি হয়তো এখানকার মানুষের তো অগাধ ভালোবাসা! যে কারণে ময়ূর টিকে আছে এখনও। একসময় ট্রেন এসে থামল নতুন দিলি¬র পাহাড়গঞ্জ রেলস্টেশনে। লাগেজসহ ট্রেন থেকে নেমে প্রধান সড়কে দাঁড়াতেই দেখি কয়েকজন দালাল। ওরা বলছে, হোটেলে চলুন। ওদের সঙ্গে কথা বলছি না, কোনও প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছি না। এর পরও পিছু পিছু হাঁটছে। পায়ে হেঁটেই এলাম প্রায় পনেরো মিনিট লেগে গেল। কয়েকটি হোটেল দেখার পর পাহাড়গঞ্জ এলাকার এক হোটেলে উঠলাম। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে আমরা তিনজনে মিলে রওনা দিলাম হুমায়ুনের সমাধিসৌধ দেখতে। দিলি¬র চিড়িয়াখানার দক্ষিণে মথুরা রোডের অদূরেই হুমায়ুনের সমাধি। সিএনজিতে সেখানে যেতে প্রায় ৪০ মিনিট সময় লাগল। আমার ছেলে অলি হুমায়ুন টম্ব দেখে তো অবাক। ছবি তুলল। সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর ৮ বছর পর তার বিধবা পতœী হামিদা বানু এটি নির্মাণ করান। সাদা-লাল বেলে পাথর ছাড়াও হলুদ ও কালো মর্মর পাথরের মিশ্রণে এটি তৈরি বলে বারবার তাকিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফেরার সময় একজন গাইড জানালেন, এটি দেখেই পরবর্তীকালে বংশধর শাহজাহান অনুপ্রেরণা পান তাজ নির্মাণের। এছাড়া আওরঙ্গজেবের হাতে নিহত ভ্রাতা দারা, সুজা ও মুরাদের সমাধি আছে এখানে। আর প্রাঙ্গণে রয়েছে মসজিদ। হুমায়ুন টম্বে প্রবেশ করতে একেকজনের জন্য দশ রুপি করে নেয়া হয়েছিল।

হুমায়ুনের সমাধি দেখার পর পায়ে হেঁটে এলাম হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগায়। এ দরগায় এসে পরিচয় হল এক খাদেমের সঙ্গে। বয়স প্রায় ৮০ বছর। তিনি দরগা দেখানোর পর নিয়ে এলেন আলাউদ্দিন খিলজির মসজিদ দেখাতে। এরপর গেলাম শাহজাহানের কন্যা জাহানারার সমাধি, উর্দু কবি মীর্জা গালিব ও প্রসিদ্ধ কবি আমির খসরুর সমাধির কাছে। পাশাপাশি এ কবরগুলো দেখে সেখানে কিছু সময় কাটালাম। একজন জানালেন, চতুর্দশ শতাব্দীর সুফি সম্প্রদায়ের চিশতি গোষ্ঠীর চতুর্থ গুরু নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মৃত্যু হয় ১৩২৫ সালে। তিনি সমাধিস্থ হন এখানে। দরগা ঘুরে দেখতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লেগে গেল। এবার আমরা এক রেস্টুরেন্টে ঢুকে ঠাণ্ডা পানি পান করার পর দেখলাম তৃষ্ণা নিবারণ হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে আইসক্রিম খেলাম। সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে এসে বিশ্রাম নিচ্ছি, তখনই দরজায় নক। অপরিচিত একজন এসে বললেন, কাল সকাল ৯টায় গাড়ি ছেড়ে যাবে। দিলি¬ নগরীর আকর্ষণীয় স্থান দেখানো হবে। আপনারা যাবেন কিনা? বললাম, যাব না কেন? নিশ্চয়ই যাব।

পরদিন সকালে হোটেলের সামনে বাস এলো। আমরা উঠে বসলাম। হালকা-পাতলা যানজটের মধ্য দিয়ে বাস থেমে থেমে চলছে। প্রথমে বিড়লা মন্দির দেখিয়ে নিয়ে গেলো ইন্দিরা গান্ধী স্মৃতি মিউজিয়ামে। ১ নং সফদর জং রোডের এ বাড়িতে এখন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করে দেখলাম, ব্যবহার্য সামগ্রী প্রদর্শিত হচ্ছে।

ইন্ডিয়া গেটের ওখানে ২০ মিনিটের জন্য যাত্রাবিরতি। ৪২ মিটার উঁচু ওয়ার মেমোরিয়াল ইন্ডিয়া গেট। জানলাম, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত ৯০ হাজার ভারতীয় সৈন্যের স্মৃতির উদ্দেশে এটি নির্মিত হয় ১৯৩১ সালে। একজন ট্যুরিস্ট বললেন, রাতে আলোকোজ্জ্বল এ গেটের রূপ দেখার মতো। দূর থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন দেখিয়ে বাস এবার চলল কুতুব মিনারের দিকে। সেখানে প্রবেশ করতে দশ রুপি করে নেয়া হল। যাত্রাবিরতি দেড় ঘণ্টা। এ সময়ের মধ্যে খাওয়াদাওয়াসহ কুতুব মিনার দেখে নিতে হবে। কুতুব মিনারের কম্পাউন্ডের মধ্যে পরিচয় হল সতেরো বছর বয়সী একটি ছেলের সঙ্গে। বলল, একাই এসেছি কুতুব মিনার দেখতে। জিজ্ঞেস করলাম, কোন প্রদেশ থেকে এসেছ? মৃদু হেসে বলল, উত্তরপ্রদেশের বানারস শহর থেকে। নাম তুলসী রায়। কুতুব মিনারে এ নিয়ে সে দশবার এসেছে। বলল, ১১৯৯ সালে কুতুবউদ্দিন আইবেক বিজয়স্তম্ভরূপে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। আর নির্মাণকার্য সম্পন্ন হয় জামাতা ইলতুৎমিশের হাতে। ওখানে আরও দেখলাম, আলাই মিনার, ইলতুৎমিশ ও আলাউদ্দিনের সমাধি। কুতুব মিনার থেকে বেরিয়ে আমার ছেলে অলি ও তুলসী রায় একত্রে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য এক হোটেলে এলাম। তারপর তুলসীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমাদের বাসে গিয়ে উঠে বসলাম। বাস চলছে। পথে দেখানো হল জওহরলাল নেহরুর বাড়ি। সেখানে আর নামা হল না। এবার বাস এলো রাজঘাটে। এখানেই যমুনার ধারে মহাত্মা গান্ধীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দেখলাম, রাজঘাটে কালো পাথরের সমাধি। কাছেই শান্তিবন, সেখানে গেলাম। দেখলাম, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সমাধি। কাছেই ছিল এক ফুল বিক্রেতা। তার কাছ থেকে দুটি গোলাপ নিয়ে নেহরুর সমাধিতে দিলাম। তখন ছেলেকে বললাম, আমার অনেক দিনের আশা ও স্বপ্ন আজ পূরণ হল।

বাসে উঠলাম। গাইড বলল, এবার লালকেল্লা নিয়ে যাচ্ছি। সেখানে এক ঘণ্টার মধ্যে সবকিছু দেখে নেবেন। লালকেল্লায় প্রবেশ করে একে একে দেখে নিলাম মোগল ভবন, মীনাবাজার, নহবৎখানা, দেওয়ানি আম, দেওয়ানি খাস, ময়ূর সিংহাসন, রংমহল, মতি মসজিদ। দেওয়ানি খাস দেখিয়ে গাইড জানালেন, একদা মণিমুক্তাখচিত ছিল এখানে। আগ্রা থেকে এনে বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসন বসানো হয়েছিল ওই জায়গায়। পারস্যের নাদির শাহ ১৭৩৯ সালে লুট করে নিয়ে যায় সোনার তৈরি, মণিমুক্তা ও রতœ বসানো যাবতীয় কিছু। এক সময় দেওয়ানি খাসের দেয়ালের কার্নিশে স্বর্ণাক্ষরে লেখা ছিল ফার্সি ভাষায় শ্লোক : আগার ফিরদৌস বরকয়ে জমিনস্ত, হামিনস্তও, হামিনস্তও। অর্থাৎ পৃথিবীতে স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তবে তা এখানেই, এখানেই, এখানেই।
দুর্গ থেকে বেরিয়ে গেলাম জামে মসজিদের কাছে। লালকেল্লার বিপরীতে এটি সম্রাট শাহজাহান নির্মিত ভারতের বৃহত্তম মসজিদ। মসজিদের ভেতর প্রবেশ করে এর কারুকার্য দেখে অবাক হলাম। এখানেই পরিচয় হল এক মুসলি¬র সঙ্গে। তাকে বললাম, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। শুনে তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশে যেতে মন চায়। তিনি জানালেন, লাল বেলে পাথরের ও শ্বেত মর্মরের তৈরি এ মসজিদ নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল পাঁচ বছর।
এভাবে দেখে দেখে একটানা পাঁচ দিন ছিলাম দিল্লিতে। তিন দিন ঘুরে দেখা আর দুই দিন হোটেলে শুয়ে-বসে রেস্ট নিয়েছিলাম। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ভেজিটেবল স্যুপ খেয়ে বেশ তৃপ্তি পেতাম। তবে এবার দিলি¬ ভ্রমণ করে বুঝলাম, খাওয়াদাওয়ার জন্য বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। হোটেলের অভ্যন্তরে রান্নাবান্না হচ্ছে এবং তা রুমে রুমে পৌঁছে দেয়ার সুব্যবস্থাও রয়েছে এখন। হোটেলের বয়-বেয়ারাদের আতিথেয়তাও কিন্তু ভোলার নয়। বয়রা এসেছে কেউ বিহার থেকে, কেউ নেপাল বা গুজরাট থেকে। হোটেল বয় জয় সিন্হার আন্তরিকতার কথা ভোলা যাবে না। পরদিন আমরা দিল্লি ছেড়ে জয়পুরের দিকে রওনা হলাম। বাসে বসে শুধুই মনে পড়ছিল। ভেবেছি সময় পেলে আবার না হয় আসব এই দিল্লিতে। দিল্লিতে যে বারবার ভ্রমণ করতে মন চায়। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে এর নাম ছিল শাজাহানাবাদ। আর এখন তো দিল্লি। অর্থাৎ ভারতের রাজধানী তা সবারই জানা।


-লিয়াকত হোসেন খোকন
প্রকাশ : 30 এপ্রিল 2011
http://touristguide24.com

                                 





       
         


No comments: